দেলোয়ার হোসেন (রামগতি ,লক্ষ্মীপুর)
লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির নামে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস-ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিরা পকেট ভারী করতে পাঁয়তারা করছেন। সরেজমিনে উপজেলার বড়খেরী, চরআব্দুল্লাহ, চররমিজ, চরগাজী, চরপোড়াগাছা, চর আলেকজান্ডার, চরআলগী ও চরবাদাম ইউনিয়ন ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
অফিস সুত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে রামগতি উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ৩০৫২ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৪ কোটি ৮৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এই টাকা লুটপাট করার জন্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যোগসাজশে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা তাদের অনুসারীদের শ্রমিক বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
তবে ইউএনও বলেন,অনিয়ম করার কোন সুযোগ নেই। অনিয়মের অভিযোগ পেলেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অতিউৎসাহী হয়ে চেয়ারম্যান ও পরিষদের সদস্যরা তাদের অনুসারীদের দিয়ে ইউনিয়ন ব্যাপী শ্রমিকদের তালিকা করিয়েছেন। পরে তা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে দাখিল করা হয়েছে। এতে উপজেলায় ৩০৫২ জন শ্রমিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তালিকায় থাকা শ্রমিকদের কোন কাজে ব্যবহার না করে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি ভরাট করেন ।
এমনকি তালিকায় শ্রমিকের নাম থাকলেও তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানেনা এমন অভিযোগও রয়েছে শতাধিক। আবার এক রাস্তায় বার বার প্রকল্প দিয়ে সরকারী টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস সুত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের শুরুতেই হতদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসূচি প্রকল্প নিয়ে পিআইও এবং ইউপি চেয়ারম্যানদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। চেয়ারম্যানরা কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দেন পিআইওকে।
কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন এবার প্রত্যেক শ্রমিকের নামে আলাদা আলাদা মোবাইল একাউন্টে টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে এখন পর্যন্ত কোন শ্রমিক টাকা পায়নি।
এই নিয়েই মুলত চেয়ারম্যান ও পিআইওর মতবিরোধ দেখা দেয়। পরে ইউএনওর হস্তক্ষেপে বিষয়টি সমাধান হয়। অনেক ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিরা নামে মাত্র কাজ শেষ করেন। আবার অনেক ইউনিয়নে কোন কাজ হয়নি বলে জানান কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান। এতে তালিকাভুক্ত শ্রমিকরা কাগজ কলমেই রয়েছেন। কর্মসৃজন কর্মসূচির টাকা যাবে চেয়ারম্যানদের পকেটে। আর এতে বিশাল একটি অংশ যাচ্ছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার নিকট।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক কয়েকজন চেয়ারম্যান জানান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ঐ অফিসের অফিস সহকারী আব্দুল হাকিমকে দিয়েই সকল অনৈতিক কাজের লেনদেন করা হয়।
শুধু ৪০ দিনের কর্মসূচি নয়, টিআর কাবিখার নামে আসা বরাদ্দ গুলো থেকেও অফিস সহকারী আব্দুল হাকিমকে দিয়ে তিনি কমিশন গ্রহন করেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। রামগতিতে টিআর কাবিখার বরাদ্দ গুলোর কোন কাজ হয়নি। সরেজমিনে গিয়ে টিআর কাবিখার প্রকল্পগুলোর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করার অপচেষ্টা করছেন ইউপি চেয়ারম্যান-পিআইও ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। ৮টি ইউনিয়নের অন্তত শতাধিক শ্রমিক ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে কোন প্রকল্পেই শ্রমিক পাওয়া যায়নি। কিছু কিছু প্রকল্পে ভেকু মেশিনেই মাটি কাটা হচ্ছে। তাতেও নয়ছয় করে যেন সরকারি টাকা পাঁয়তারার এক মহা উৎসব চলছে। শ্রমিক নেই, কিন্ত মোবাইল একাউন্টে শ্রমিকের নাম ব্যবহার হচ্ছে ঠিকই। শ্রমিকের নামে একাউন্ট থাকলেও টাকা যাবে প্রকল্প সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছে। শ্রমিকের নামের সিম সবগুলো চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নিকট। শ্রমিকরা এব্যপারে কিছুই জানেননা।
সরেজমিনে গেলে এক ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করা শর্তে এই জানান, কাজ হউক বা না হউক শতকরা ২৫ পার্সেন্ট টাকা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসে দিতে হবে। টাকা না দিল অর্থ ছাড় হবেনা। এমন অভিযোগ প্রায় সবকয়টি প্রকল্প সভাপতি, ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের।
এদিকে কর্মসৃজন কর্মসূচি নিয়ে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম উপজেলা পরিষদের সামনে ভান্ডারী হোটেলে রামগতি উপজেলার কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিক নেতাকে নিয়ে বৈঠক করেন। ঐ বৈঠকে পিআইও ৪০ দিনের কর্মসূচি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন,আমি আপনাদের জন্য সম্মানজনক ব্যবস্থা করবো। প্লীজ নিউজ করবেননা। আমি আপনাদের জন্য কি করি একটু দেখেন। এমন অনুরোধ জানিয়ে উর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা কর্তৃক প্রেরিত মোবাইল বার্তার ম্যাসেজ দেখান সাংবাদিকদেরকে। সেই ম্যসেজে তাদেরকে কমিশন দেওয়ার কথা উল্লেখ ছিলো। তিনি বলেন, শতভাগ কাজ করতে পারিনা। অফিস টু অফিস কমিশন দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন জেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত কমিশন দিতে হবে।
বালুচর এলাকার বাসিন্দা রায়হান ও চরগাজীর তেগাছীয়া এলাকার ইলিয়াস, চরবাদাম ইউনিয়নের রফিক, বলেন, শ্রমিক দেখি নাই, ভেকু মেশিনে মাটি কাটা হচ্ছে।
কয়েকজন প্রকল্প সভাপতি জানান, পিআইও ও চেয়ারম্যানরা যেভাবে বলছে, তারা সেভাবেই কাজ করছেন। আর কমিশন বাণিজ্যের কারণে শতভাগ কাজ করা সম্ভব না।
জানতে চাইলে চরপোড়াগাছা ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন হাওলাদার, চর আব্দুল্লাহ ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন মন্জু বলেন, পিআইও অফিসকে ২৫% কমিশন দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান, সরকারি বরাদ্দকৃত অল্প টাকায় রাস্তা নির্মাণ সম্ভব নয়।
রামগতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ( ইউএনও) এসএম শান্তনু চৌধুরী বলছেন, অনিয়ম করার কোন সুযোগ নেই। অনিয়মের অভিযোগ পেলেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।