ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কমিটি দ্বন্দ্ব :নৈতিক অবক্ষয়ের তলানিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

শেয়ার

ফিরোজ আলম:নৈতিকতার ইংরেজি শব্দ মোরালাটি।
লাতিন শব্দ “মোরালিটাস”,থেকে মোরালিটির উৎপত্তি। যার অর্থ চরিত্র, ভদ্রতা, সঠিক আচরণ ।বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিকতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতির মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নৈতিকতাকে একটি আদর্শিক মানদন্ড ও বলা যেতে পারে।অন্যদিকে ধর্মবোধের প্রকৃত ভিত্তিই হ’ল নৈতিকতা। এ জন্য ইসলাম সহ সকল ধর্মেই নৈতিকতার গুরুত্ব ও প্রাধান্য সবচেয়ে বেশী। নৈতিকতা কোন ব্যক্তির মধ্যে এমন আচরণ কিংবা গুনাবলি তৈরি করে , যা অপরের প্রতি ক্ষমা ও মার্জনা, উদারতা ও দানশীলতা, ধৈর্য্য, বিনয় ও নম্রতা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর অবক্ষয় শব্দের মানে হলো ক্ষয়প্রাপ্তি। মানবজীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে হলে কিছু গুণের প্রয়োজন হয়। আর মানুষের এই গুণগুলি যখনই লোপ পায় বা নষ্ট হয় তখনই শুরু হয় নৈতিক অবক্ষয়।সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে এই নৈতিক অবক্ষয়ের চরমদশা পরিলক্ষিত হচ্ছে।আমাদের নৈতিক বিপর্যয়ের চরম সীমায় অবস্থান করছি আমরা এখন।নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে দিন দিন সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। তুচ্ছ ঘটনা বা সামান্য স্বার্থের জন্য কত মানুষকে জীবন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নৈতিক বা অনৈতিক বিবেচনা না করেই আমরা নিজের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া হইয়া উঠেছি।ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বলতে সাধারনত মসজিদ , মাদ্রাসা,হিন্দুদের উপাসনালয় কে বোঝায়।গত কয়েক বছর ধরেই এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কারা নেতৃত্ব দিবে তা নিয়ে প্রকাশ্যেই মারামারি হচ্ছে।এমনকি কমিটিতে আধিপত্য রাখতে খুনের মত জঘন্য ঘটনা ও পরিলক্ষিত হচ্ছে।কমিটিতে স্থান পেতে অস্ত্রের ঝনঝনানি ও এখন দৃশমান।আশংকার বিষয় হল মসজিদ কমিটির লোকজনের কাছেও নাকি পিস্তল ও ভারি অস্ত্র থাকে। এবার গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মসজিদ – মাদ্রাসার কমিটি নিয়ে মারামারি -হানাহানির কিছু ঘটনা লক্ষ্য করি। কিছুদিন আগে খুলনার ফুলতলা উপজেলার মশিয়ালী গ্রামে মসজিদ কমিটিতে কারা থাকবে- তা নিয়ে দু’পক্ষের গোলাগুলিতে তিনজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে সাতজন। লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা জামে মসজিদে কিছুদিন আগে জুমার নামাজ শেষে মসজিদ কমিটিকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ৬ মুসল্লি আহত হন।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নায়েকের হাট দারুস সুন্নাত দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপারের পদ নিয়ে কমিটির দ্বন্দ্বে দুই শিক্ষকের মাঝে হাতাহাতি ও মারামারীর ঘটনা ঘটেছে। কয়েক দিন আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৮নং ওয়ার্ডে শহরের নলুয়া জামে মসজিদ কমিটি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ব্যপক সংঘর্ষে ১৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কবির হোসেন ও সাবেক কাউন্সিলর মোঃ কামরুল হাসান মুন্না সহ দুই পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে।
এ ঘটনায় কবির হোসেন ও সাবেক কাউন্সিলর মোঃ কামরুল হাসান মুন্না সহ ২২জনকে গ্রেফতার করে ৭ দিন করে রিমান্ড আবেদন করে পাঠায় পুলিশ।
এদিকে কিছুদিন আগে জামালপুরে মসজিদ কমিটির দ্বন্দ্বের জেরে মুক্তার হোসেন মুক্তা (৩২) নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে ও শাবল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন।
এবার তাবলিগ জামাতের কথা বলি। মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভীর (র.) প্রচেষ্টায় বিংশ শতকের বিশ দশকের কোনো এক সময় তাবলিগ জামাতের যাত্রা শুরু হয় ভারতের দিল্লির মেওয়াত এলাকায়। ঐ সময় দিল্লির মেওয়াত এলাকার মুসলিম সমাজের অঅধিকাংশই ইসলামের ‘প্রকৃত শিক্ষা’ ভুলে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়। এমনকি তাদের জীবনাচরণের মধ্যে ধর্মীয় চর্চা গায়েব হয়ে যায়।এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (র.)–এর এসব মুসলিমকে ইসলামের চর্চার মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তাবলিগের জন্ম হয়।
কিন্তু তাবলিগ জামাতের মধ্যে এক পক্ষ মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারী, আর অন্য পক্ষ মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারীদের মধ্যে সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব , সংঘর্ষ,মারামারি,খুনাখুনি সাধারণ মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন জাগায়, হঠাৎ করে তাবলিগ জামাতের সাথিরা কেন হানাহানি এমনকি হত্যার মত সহিংস আচরণ করছেন ?কেননা তাবলিগ জামাত ই তো দুনিয়াবি বিষয়ের চেয়ে পরকালিন মুক্তির বিষয়গুলো নিয়েই বেশি মনোনিবেশ করে থাকেন।উত্তর একটাই ,কে হবে তাবলিগের নেতা।মাওলানা সাদ নাকি মাওলানা যোবায়ের।

এবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আহমদ শফী এবং বাবুনগরীর দ্বন্দ্বের কথা আলোচনা করি।হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে আহমদ শফীর বিরুদ্ধে জুনায়েদ বাবুনগরীর সমর্থক ছাত্রদের বিক্ষোভে আহমদ শফী পদত্যাগ করেন এবং একদিন পর তিনি মারা ও যান।যদিও এর আগে বাবু নগরীকে ও আহমদ শফী দ্বারা চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এবার দেশের বাহিরের কথা বলি।সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিকাট অঙ্গরাজ্যে একটি মসজিদের গঠনতন্ত্রে কিছু সংশোধনের দাবি ও আর্থিক অসততার অভিযোগে এবং কমিটির আধিপত্য নিয়ে মারামারি করেছেন দুই পক্ষের কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশী। থেমে নেই হিন্দুেদের মাঝে ও সংঘর্ষ।ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভাতগাঁও গ্রামের শ্রীশ্রী রসিক রায় জিও মন্দিরে কিছু দিন আগে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে রাতে দুষ্কৃতকারীরা মন্দিরের দুর্গাপূজার প্রতিমা ভাঙচুর করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ জন্য সনাতন মতাদর্শ এবং আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) পন্থীরা পরস্পরকে দোষারোপ করছে।
এবার আলোচনা করা যাক মসজিদ-মাদ্রাসা কমিটিতে কারা আসবেন তা নিয়ে কোরান কি শিক্ষা দেয়।পবিত্র কোরানের সূরা তাওবার ১৮ নং আয়াতে আছে একমাত্র তারাই আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, ওরা হিদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
হাদীসে আছে
আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন আমানত নষ্ট করা হবে তখন থেকে কিয়ামতের অপেক্ষা করতে থাকবে। জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) কীভাবে আমানত নষ্ট করা হবে? তিনি বললেন, যখন অযোগ্যকে দায়িত্ব দেয়া হবে তখন থেকে কিয়ামতের অপেক্ষা করতে থাক। -সহিহ বুখারি: ৬৪৯৬
আদ দুররুল মুখতার, ওয়াকফ অধ্যায় আছে –
মসজিদ কমিটির কোনো সদস্যে কবিরা গুণাহতে জড়িত থাকার বিষয়টি সমাজে প্রকাশ পেয়ে গেলে তাকে বরখাস্ত করা ওয়াজিব। এমনকি, সে যদি জমিদাতা কিংবা ওয়াকফকারী কর্তৃক মনোনীতও হয় তবুও তাকে বরখাস্ত করতে হবে।
আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমরা কোনো পদপ্রার্থী বা পদপ্রত্যাশীকে পদ দেই না। -সহিহ বুখারি: ৭১৪৯
রাসূল (সা: ) বলেছেন তুমি পদপ্রার্থী হবে না। যদি প্রার্থী হয়ে পদ পাও তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে তা তোমার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। আর যদি প্রার্থী না হয়ে পদ পাও তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালনে তোমাকে সাহায্য করা হবে। -সহিহ বুখারি: ৭১৪৭
রাসূল (সা.) বলেছেন, অতি শীঘ্রই তোমরা পদের প্রতি লোভী হবে। কিয়ামতের দিন তা লজ্জার কারণ হবে। -সহিহ বুখারি

আলেমদের অভিমত হল আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছায় ইবাদত মনে করে খেদমতের মানসিকতা নিয়ে কমিটিতে অংশ নিতে হয়। সামাজিক পদমর্যাদা বৃদ্ধির অভিলাষে কমিটিতে যোগ দেওয়া হারাম।

সাধারনত মসজিদ কমিটির দায়িত্ব হল মসজিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের সংরক্ষন করা,আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব স্বচ্ছভাবে সংরক্ষণ করা।বিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শে যোগ্য ইমাম ও মোয়াজ্জিন ,প্রয়োজন অনুপাতে খাদেম নিয়োগ দেয়া,প্রয়োজন অনুসারে মসজিদের নির্মাণ, মেরামত ও সংরক্ষণ কাজ সম্পন্ন করা।অজু, ইস্তেঞ্জা, পানি, বাতি, পাখা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।মাদ্রাসা কমিটি ও কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অনুরুপ কার্য সম্পাদান করেন।

মসজিদ কমিটি গঠনে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা ভাল

এক• পরামর্শ ভিত্তিক এলাকার প্রাপ্ত বয়ষ্ক ও মানসিকভাবে সুস্থ এমন গ্রহনযোগ্য মুরুব্বি, নামাজি, পরহেজগার ও জ্ঞানী মুসলিমদেরকে মসজিদে কমিটিতে স্থান দেওয়া যেতে পারে।
দুই• মসজিদের জমিদাতা কিংবা গ্রামবাসী যাকে যোগ্য মনে করে এমন মানুষকে মসজিদ কমিটিতে নেওয়া যেতে পারে।
তিন•শরীয়তের মাসআলার জ্ঞান থাকা এবং মসজিদ ব্যবস্থাপনার বৈষয়িক যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা।
চার•আমানতদার হওয়া।
পাঁচ•জুয়া বাজ , মদ্যপায়ী, এক কথায় কবিরা গুণাহতে প্রকাশ্যে লিপ্ত ব্যক্তি, বেনামাজি, , রোজা রাখে না, ফরজ হওয়া সত্ত্বেও হজ্ব করে না, জাকাত দেয় না, সুদি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, সুদ গ্রহণ করে এককথায় প্রকাশ্য পাপকাজে লিপ্ত কাউকে মসজিদ কমিটির জন্য মনোনীত করা কোন মতেই উচিত হবে না

ফিরোজ আলম,বিভাগীয় প্রধান,আয়েশা ( রা%) মহিলা অনার্স কামিল মাদ্রাসা, সদর, লক্ষীপুর।
প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক,কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটি এবং সাধারন সম্পাদক লক্ষীপুর জেলা শাখা,বিএমজিটিএ।
ইমেইল[email protected]
মোবাইল-01722064525

No widgets found. Go to Widget page and add the widget in Offcanvas Sidebar Widget Area.